মেজর নাসির উদ্দিন আহমেদ (অব.) পিএইচডি : বর্তমান বিশ্বে এক আতঙ্কের নাম অর্থনৈতিক মন্দা। সার্বিকভাবে এ মন্দাকে সংজ্ঞায়িত করা হয় বাজারজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ব্যাপক পতন কয়েক মাসেরও বেশি স্থায়ী হলে এবং তা সাধারণত প্রকৃত জিডিপি, প্রকৃত আয়, কর্মসংস্থান, শিল্প উৎপাদন এবং পাইকারি-খুচরা বিক্রয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেললে দেশে বা বিশ্বে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে বলে ধরা হয়। বিভিন্ন কারণে এ ধরনের মন্দা হতে পারে। অতীতে আর্থিক সংকট, বাণিজ্যে পতন, সরবরাহ ঘাটতি, কৃত্রিম সংকট, বড় আকারের প্রাকৃতিক বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ১৯৭৪ সালে দি নিউইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে আমেরিকার শ্রম পরিসংখ্যান ব্যুরোর কমিশনার জুলিয়াস শিসকিন কয়েকটি উপসর্গকে আর্থিক মন্দার লক্ষণ বলে উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে তিন মাস করে পরপর দুই প্রান্তিকে মোট জাতীয় উৎপাদন (জিডিপি) হ্রাস, ছয় মাস মেয়াদে শিল্প উৎপাদনে পতন, কর্মসংস্থান হ্রাস ও বেকারত্ব বৃদ্ধি ইত্যাদি। জিডিপি ১০ শতাংশ কমে গেলে বা কোনো মন্দা তিন বা চার বছর দীর্ঘায়িত হলে তা গুরুতর বা ব্যাপক অর্থনৈতিক মন্দা হিসেবে পরিচিতি পায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতে, প্রতি ৮ থেকে ১০ বছরের মধ্যে বিশ্বব্যাপী মন্দা দেখা দিতে পারে, যা অতীতে প্রায় এমন চক্রাকারে ঘটতে দেখা গেছে। ২০০৯ সালের এপ্রিলে আইএমএফ তাদের বৈশ্বিক মন্দার সংজ্ঞা পরিবর্তন করে বলেছে, বার্ষিক মাথাপিছু আয় ও প্রকৃত বিশ্ব জিডিপিতে একটি পতন যদি সাতটি অন্য বৈশ্বিক সামষ্টিক অর্থনৈতিক সূচকের মধ্যে এক বা একাধিকের জন্য হ্রাস বা অবনতির কারণ হয় (যার মধ্যে রয়েছে শিল্প উৎপাদন, বাণিজ্য, মূলধন প্রবাহ, তেলের ব্যবহার, বেকারত্বের হার, মাথাপিছু বিনিয়োগ এবং মাথাপিছু ব্যবহার) এবং যদি তা দীর্ঘস্থায়ী হয়, তবে অর্থনৈতিক মন্দা ঘটেছে বলে গণ্য করা যায়। এ নতুন সংজ্ঞা অনুসারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মোট চারটি বিশ্ব মন্দা সংঘটিত হয়েছে যথাক্রমে ১৯৭৫, ১৯৮২, ১৯৯১ এবং ২০০৯ সালে। এরপর ২০২০ সালে, কভিড-১৯ জনিত লকডাউন এবং ২০২০ সালের প্রথম দিকে গৃহীত বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপগুলো বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যায়, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিশ্ব মন্দা। এর ঠিক তিন বছরের মাথায় আসন্ন বিশ্ব মন্দা অতীতের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে দিয়েছে। আর এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা করছেন বিশ্বের নামি দামি সব আর্থিক ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারেরা।
টেসলার সিইও ইলন মাস্ক : বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তির নাম ইলন রিভে মাস্ক। দক্ষিণ আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া এ মার্কিন ধনকুবে একাধারে গাড়ি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান টেসলা, মহাকাশ যান ও মহাকাশ ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্প্যাসেক্স, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই-সহ বিশ্বের বেশ কিছু প্রথম সারির ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা, সিইও এবং মালিক। ২১০ বিলিয়ন ডলার বা ২১ লাখ কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এ ধনকুবের। তিনি বিশ্বাস করেন বাজার ব্যবস্থাপনা, মুদ্রাস্ফীতি, মূল্য স্তর, প্রবৃদ্ধির হার, জাতীয় আয়, মোট দেশীয় পণ্য (জিডিপি) উৎপাদন এবং বেকারত্বের মতো বিষয়গুলো অর্থাৎ ব্যাষ্টিক অর্থনৈতিক অনবরত পূর্বাভাস তৈরি করা অর্থনীতিতে দুর্যোগের একটি রেসিপি বা ইঙ্গিত। বিগত জুলাই মাসে শেয়ারহোল্ডারদের এক বৈঠকে তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৮ মাসের জন্য একটি হালকা মন্দার সম্মুখীন হবে। বার্তাসংস্থা রয়টার্স নিজ কর্মীদের কাছে ইলন মাস্কের লেখা একটি অভ্যন্তরীণ ই-মেলের বরাতে বার্তা সংস্থা রয়টার্স দাবি করেছে যে মাস্ক স্বয়ং টেসলার নীতিনির্ধারকদের কাছে অর্থনীতি সম্পর্কে তার তীব্র আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন এবং নতুন নিয়োগ বন্ধ ও ১০ শতাংশ কর্মী কমানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইলন মাস্ক গত অক্টোবরে বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, উত্তর আমেরিকার আর্থিক অবস্থা আপাত ভালো রয়েছে কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত উত্তর আমেরিকাকে পিছিয়ে দিয়েছে। তার মতে ব্যাপক ও দ্রুত মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটে অনেক কিছুই পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায়, যা সামনে দেখা যায় না, যেমনটা ছুটন্ত গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে অনেক কিছু দেখা যায়, যা উইন্ডশিল্ড দিয়ে সামনে দেখা যায় না।
ফেডেক্সের সিইও রাজ সুব্রামানিয়াম : ৫০ বছর ধরে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে মানুষের ঘরে ঘরে ও বাণিজ্য কেন্দ্রে নানা ধরনের পণ্য ও ডকুমেন্ট নিরাপদে পৌঁছে দিয়ে বিশ্বব্যাপী আস্থা অর্জন করেছে আমেরিকার ফেডারেল এক্সপ্রেস করপোরেশন, সংক্ষেপে-ফেডেক্স। স্বনামধন্য এ শিপিং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বর্তমান কর্ণধার বা সিইও ভারতে জন্ম নেওয়া এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও এমবিএ অধ্যয়ন করা রাজ সুব্রামানিয়াম। তার মতে আমদানি, রপ্তানি, পরিবহন এবং ডকুমেন্ট প্রেরণ বিশ্ব বাণিজ্যের অবিচ্ছেদ অনুষঙ্গ, যা শিপিং কোম্পানিগুলো করে থাকে। ফলে শিপিং বাণিজ্যই বিশ্ব বাণিজ্যের প্রতিফলন ঘটায়। এক্ষেত্রে দেখা যায় বিগত মাসগুলোতে শিপিং কোম্পানির আয় ছিল নিম্নগামী। ৩১ আগস্টের হিসাবে ফেডেক্সের শেয়ার প্রতি আয় ৫.১৪ ডলার থেকে কমে ৩.৪৪ ডলারে এসে দাঁড়ায়। এ তথ্য জানিয়ে ফেডেক্সের সিইও রাজ সুব্রামানিয়াম আমেরিকার সংবাদ মাধ্যম সিএনবিসি-কে ১৫ সেপ্টেম্বরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি পৃথিবীময় মন্দার ভিতর প্রবেশ করতে শুরু করেছে। আপৎকালীন ব্যবসা হিসাবে ফেডেক্স ৯০টি স্থানীয় কেন্দ্র ও পাঁচটি করপোরেট অফিস বন্ধ, ফ্লাইট সংখ্যা কমানো, নতুন নিয়োগ বন্ধ, নতুন প্রকল্প স্থগিত করাসহ বেশ কয়েকটি আক্রমণাত্মক ব্যবস্থা বা কঠোর নীতি ঘোষণা করেছে।
রেস্টোরেশন হার্ডওয়্যারের সিইও গ্যারি ফ্রাইডম্যান : রেস্টোরেশন হার্ডওয়্যার হলো আমেরিকার একটি অভিজাত ও উচ্চমানের আসবাবপত্র ও গৃহসজ্জাসামগ্রী প্রস্তুত ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান, যার সদর দফতর ক্যালিফোর্নিয়ার কোর্টি মাডেরা এলাকায় অবস্থিত। কোম্পানিটি তার খুচরা দোকান, ক্যাটালগ এবং অনলাইনের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী বিক্রি করে। আগস্ট ২০১৮ পর্যন্ত, কোম্পানিটি মোট ৭০টি গ্যালারি, ১৮টি ফুল-লাইন ডিজাইনের গ্যালারি এবং ৬টি চাইল্ড ও বেবি গ্যালারি পরিচালনা করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় কোম্পানির ৩৬টি আউটলেট স্টোর রয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন দেশে নানাভাবে তারা ব্যবসা করে থাকে। দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় এই বিশাল ব্যবসা সামলাচ্ছেন সিইও গ্যারি ফ্রাইডম্যান। সিএনএন বিজনেস রিপোর্টার এলিসন মেররোওর সঙ্গে ৯ সেপ্টেম্ব ২০২২ তারিখে আলাপকালে গ্যারি ফ্রাইডম্যান বলেন, যদি কেউ মনে করে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মন্দার মধ্যে নেই, তবে সে ‘পাগল’। ফ্রাইডম্যান সতর্ক করে আরও বলেন যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ালে তৃতীয়-ত্রৈমাসিকে তার কোম্পানির রাজস্ব ১৮ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। তার আশঙ্কা আসন্ন মন্দায় “অনেকেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবে। তার দৃষ্টিতে আবাসন ব্যবসা ইতোমধ্যে একটি মন্দার মধ্যে রয়েছে এবং এটি সবেমাত্র শুরু। সম্ভবত আবাসন খাতের জন্য আগামী ১২ থেকে ১৮ মাস কঠিন হতে চলেছে।
জে পি মরগানের সিইও জেমি ডিমন : বিগ ফোর নামে পরিচিত আমেরিকার সবচেয়ে বড় চারটি ব্যাংকের একটি এবং বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগকারী ব্যাংক হিসেবে ১৫০ বছরের বেশি সময় (১৮৭১ -২০২২) ধরে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনা করছে জে পি মরগান। এ ব্যাংকের সিইও এবং আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় ধনী ব্যবসায়ীদের একজন জেমি ডিমন চলতি অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে যোগ দিয়েছিলেন লন্ডনে অনুষ্ঠিত জে পি টেক স্টারস কনফারেন্সে এ সময় আমেরিকার জনপ্রিয় কেবল নিউজ চ্যানেল সিএনবি সি’র রিপোর্টার জুলিয়ানা ট্যাটেলবামকে তিনি একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। ২০২৩ সালের অবশ্যম্ভাবী বিশ্ব মন্দা নিয়ে তিনি বলেন, এই বিশ্ব মন্দা হবে গুরুতর, যা আমেরিকা ও পৃথিবীতে আঘাত হানবে। তিনি মনে করেন ইউরোপজুড়ে এই আর্থিক মন্দা ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে এবং আগামী ৬ থেকে ৯ মাসের মধ্যে আমেরিকায়ও একই ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিবে। তবে মন্দা কতদিন থাকবে, তা নিশ্চিতভাবে বলতে না পারলেও এর প্রভাব যে হালকা থেকে তীব্রতর হবে, তা প্রায় নিশ্চিত বলে মনে করেন তিনি। তবে কোনো কিছু সঠিকভাবে অনুমান করা কঠিন বিধায় যে কোনো বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতির প্রতি তাগিদ দেন জে পি মরগানের সিইও। অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কোন দিকে গড়ায়, তার ওপরও অনেক কিছু নির্ভরশীল বলে তার অভিমত। জেপি মর্গান ব্যাংককে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ কিংবা আমেরিকার কেন্দ্রীয় বা রিজার্ভ ব্যাংকের নীতির কারণে সৃষ্ট ‘হেরিকেন’ বা অর্থনৈতিক ঝড় থেকে রক্ষার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও তিনি গণমাধ্যমকে অবহিত করেন।
গোল্ডম্যান স্যাকসের ডেভিড মাইকেল সলোমন : অতি সম্প্রতি (১৮ অক্টোবর ২০২২) আমেরিকার ১৫৪ বছরের পুরনো (১৮৬৯-২০২২) এবং পৃথিবীর অন্যতম ও অভিজাত বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকসের অর্থনৈতিক মন্দা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে। ব্যাংকটির দৃষ্টিতে ২০২৩ সালে মুদ্রা স্ফীতির দুটি মূল উপসর্গ বাসস্থান বা বাড়ি-ঘর ক্রয় বা ভাড়া ও স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় আমেরিকার জনগণকে অস্বস্তিকর পর্যায়ে নিয়ে যাবে। তবে মন্দা প্রশ্নে অন্য যে কোনো ব্যাংক বা সংস্থার তুলনায় অনেক কম ঝুঁকি অনুভব করে গোল্ডম্যান স্যাকস। তাদের মতে আমেরিকার ভয়াবহ রকমের অর্থনৈতিক মন্দা দেখার সম্ভাবনা ৩৫ শতাংশ মাত্র। বিশ্বের অন্যতম সেরা বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ডেভিড মাইকেল সলোমন (৬০) অংশীজনদের অবহিত করে বলেন, বিশ্ব অর্থনীতি প্রবল উল্টো বাতাসের বা হেডউইন্ডের মুখোমুখি হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি যথারীতি উচ্চ স্তরে রয়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এমন গতিতে সুদের হার বাড়াচ্ছে, যা কয়েক দশকে দেখা যায়নি। ভূ-রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জ্বালানির উচ্চ মূল্য বিরাজমান উদ্বেগ চলমান রেখেছে এবং মোট দেশীয় উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির প্রত্যাশা হ্রাস পাচ্ছে।
হিলটনের সিইও ক্রিস নাসেটা : আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সে দেশের অর্থনীতিকে ক্রমাগত অবনতির দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন পৃথিবীর ১১৮টি দেশে হোটেল ও রিসোর্ট ব্যবসা পরিচালনাকারী গ্রুপ হিল্টনের ক্রিস নাসেটা। গত ১৫ বছর ধরে এ গ্রুপের সিইও হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ক্রিস নাসেট। তথ্য মতে হোল্টনের সব হোটেল মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার রুম রয়েছে। এ গ্রুপের সফল সিইও ক্রিস নাসেটার মতে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংক আমেরিকার অর্থনীতিকে ‘নরম-থেকে-বাম্পি ল্যান্ডিং’-এর দিকে বা অধপতনের দিকে নিয়ে যাবে। বিগত ১৫ বছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকার সুদ বাড়ানো-কমানোর বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই সিইও ৪০ বছরের মধ্যে সর্বাধিক মুদ্রাস্ফীতির প্রেক্ষাপটে হোটেলের রুম ভাড়া ও অন্যান্য চার্জ বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিয়েছেন, যা এক সময়ের পরম শক্তিশালী মার্কিন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য একটি সংকেত। তিনি নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে মনে করেন যে আমেরিকা একটি অর্থনৈতিক মন্দা পেতে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাস : বিশ্বব্যাংকের গত ১৫ সেপ্টেম্বরের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস বলেন যে, বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি তীব্রভাবে মন্থর হচ্ছে এবং আরও বেশি দেশ মন্দার মধ্যে পড়ার কারণে অধিকতর মন্থর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। গভীর উদ্বেগ হলো, এ প্রবণতাগুলো অব্যাহত থাকবে, যা দীর্ঘস্থায়ী পরিণতিতে উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতির মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক। বিশ্বজুড়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো প্রায় একই সময়ে মুদ্রাস্ফীতির প্রতিক্রিয়া হিসেবে সুদের হার বাড়িয়েছে। এর ফলে বিশ্ব ২০২৩ সালে একটি বৈশ্বিক মন্দার দিকে অগ্রসর হতে পারে এবং উদীয়মান বাজার এবং উন্নয়নশীল অর্থনীতি আর্থিক সংকটের মুখোমুখি হতে পারে। এ সংকট দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। যদি সরবরাহ এবং শ্রম-বাজারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়, তবে সুদের হার বৃদ্ধি জনিত কারণে ২০২৩ সালে বিশ্বব্যাপী মূল মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় ৫ শতাংশে থেকে যেতে পারে, যা মহামারি হওয়ার আগের পাঁচ বছরের গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। ডেভিড মালপাস মনে করেন নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির হার, মুদ্রার স্থিতিশীলতা এবং দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য নীতিনির্ধারকরা খরচ কমানো থেকে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে তাদের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে পারেন। তবে তাদের উচিত এমন নীতি উপহার দেওয়া যা অতিরিক্ত বিনিয়োগ তৈরি করতে এবং উৎপাদনশীলতা এবং মূলধন বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা : আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা গত ৬ অক্টোবর আমেরিকার জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে একটি সেমিনারে বলেছেন, আইএমএফ আবার ২০২৩ সালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাক্সিক্ষত মাত্রা কমিয়েছে এবং ২০২৬ সালের মধ্যে বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৪ ট্রিলিয়ন ডলার কম হওয়ার অনুমান করছে। তার মতে বিশ্ব অর্থনীতি আরও খারাপ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তিনি মনে করেন, ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ইউক্রেনে রাশিয়ান আক্রমণ নাটকীয়ভাবে অর্থনীতিতে আইএমএফের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করেছে এবং মন্দার ঝুঁকি বাড়িয়েছে। তার মতে বর্তমান সময়কে অর্থনৈতিক পরিবেশের কারণে একটি ঐতিহাসিক ভঙ্গুরতার সময় বলা যায় এবং বিশ্ব অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য অনিশ্চয়তার মুখোমুখি বলা যায়। তার দেওয়া তথ্য মতে, আইএমএফ অনুমান করেছে, বিশ্ব অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ নিয়ন্ত্রণকারী দেশগুলো পর পর দুটি কোয়ার্টারে বা তিন মাসের দুটি প্রান্তিকে এ বছরে বা পরের বছর অর্থনৈতিক সংকোচন দেখতে পাবে। এ প্রসঙ্গে তিনি সবাইকে মনে করিয়ে দেন, বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা ইতোমধ্যে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস বা অনুমানকে তিনবার কমিয়েছে। এটি এখন ২০২২ সালের জন্য ৩.২ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের জন্য ২.৯ শতাংশ হবে বলে আশা করছে। জর্জিভার ধারণা মাত্রাতিরিক্ত ও অতি দ্রুত আর্থিক নীতি কঠোর করা এবং দেশজুড়ে প্রয়োগ করা অনেক অর্থনীতিকে দীর্ঘায়িত মন্দার দিকে ঠেলে দিতে পারে।
সিটাডেলের সিইও কেন গ্রিফিন : “সিটাডেল এলএলসি আমেরিকান একটি বহুজাতিক হেজ ফান্ড এবং আর্থিক পরিষেবা সংস্থা। দ্রুত বর্ধমান এবং নির্ভরযোগ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান রূপে সিটাডেলের গ্রহণ যোগ্যতা রয়েছে। সেপ্টেম্বরে বার্তা সংস্থা সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও মার্কিন ধনকুবে কেনেথ গ্রিফিন বলেন, সবাই মন্দার পূর্বাভাস দিতে পছন্দ করে এবং বাস্তবে সেটাই হবে। তিনি আরও বলেন, মুদ্রাস্ফীতি এখনো শীর্ষে পৌঁছেনি তবে কখন এবং সত্যি বলতে কতটা কঠিন ভাবে ভোক্তারা মুদ্রাস্ফীতির সর্বোচ্চ স্তর প্রত্যক্ষ করবে, সেটাই প্রশ্ন। ‘২৩-এর শেষে আমাদের পক্ষে কি পরিপূর্ণভাবে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব সেটাও একটি বড় প্রশ্ন।
ডয়েচে ব্যাংকের সিইও ক্রিশ্চিয়ান সেউইং : ডয়েচে ব্যাংকের যাত্রা ১০ মার্চ, ১৮৭০ সালে। এটি একটি বহুজাতিক বিনিয়োগ ব্যাংক এবং আর্থিক পরিষেবা সংস্থা, যার সদর দফতর জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অবস্থিত। এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ এবং ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টক এক্সচেঞ্জে দ্বৈত তালিকাভুক্ত। ব্যাংকের নেটওয়ার্ক ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ায় বিশাল ৫৮টি দেশজুড়ে বিস্তৃত। ক্রিশ্চিয়ান সেউইং বর্তমানে ডয়েচে ব্যাংকের সিইও হিসেবে কাজ করছেন। ১২ অক্টোবর ২০২২ জার্মানির অর্থমন্ত্রী রবার্ট হ্যাবেক বলেন, পশ্চিমের বিরুদ্ধে রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের অর্থনৈতিক যুদ্ধের ফলে ২০২৩ সালে জার্মানির অর্থনীতি মন্দার দিকে যাবে। হ্যাবেক বার্লিনে সাংবাদিকদের আরও বলেন যে ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতি (জার্মানি) এই বসন্তের পূর্বাভাস অনুসারে ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধির পরিবর্তে আগামী বছর ০.৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। ২০২২ সালে সার্বিক অর্থনীতি বৃদ্ধির পূর্বাভাসও পূর্বের ২.২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১.৪ শতাংশে সমন্বয় করা হয়েছে। সার্বিকভাবে জার্মান সরকার নাগরিকদের মন্দার জন্য প্রস্তুত হতে বলেছিল। সেদিকে ইঙ্গিত করে ক্রিশ্চিয়ান সেউইং বলেন, আমরা আর জার্মানিতে মন্দা এড়াতে সক্ষম হব না।
মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা : বিল গেটস ও পল অ্যালেনের যৌথ প্রচেষ্টা ফসল ১৯৭৫ সালে প্রতিষ্ঠিত মাইক্রোসফট। বিশ্বের অন্যতম ও বৃহত্তম বহুজাতিক আইটি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা মাইক্রোসফট কম্পিউটার সফটওয়্যার, ব্যক্তিগত কম্পিউটার এবং ভোক্তা ইলেকট্রনিক্সের উদ্ভাবন, উৎপাদন, সার্ভিসিং ও বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। এর সফটওয়্যারের মধ্যে রয়েছে মাইক্রোসফট উইন্ডোজ ক্লাস অপারেটিং সিস্টেম, ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার এবং এজ ওয়েব ব্রাউজার এবং মাইক্রোসফট অফিস স্যুট। ভারতের হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া সত্য নাদেলার নেতৃত্বে ২০১৯ সালে মাইক্রোসফট তৃতীয় বৃহত্তম মার্কিন পাবলিক কোম্পানি হয়ে ওঠে, যার মূল্য যথাক্রমে অ্যাপেল এবং অ্যামাজন-এর পরে ১ ট্রিলিয়ন ডলারের গন্ডি অতিক্রম করে। মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলা সম্প্রতি বলেন, লোকেরা আগে মাইক্রোসফটকে ‘মন্দা-প্রুফ’ বা ‘মন্দা সহিষ্ণু’ বললেও এই প্রযুক্তি জায়ান্ট এবার ধাক্কা খাচ্ছে। সম্প্রতি মাইক্রোসফট ১ হাজার কর্মী ছাঁটাই করে, যা কোম্পানির জন্য একটি অস্বাভাবিকভাবে বড় ঘটনা। মাইক্রোসফটের শেয়ার মূল্য জানুয়ারি থেকে অন্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ২৯ শতাংশ কমেছে। অক্টোবরে ইয়াহু ফাইন্যান্সের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে ভারতের হায়দরাবাদে জন্ম নেওয়া (১৯৬৭) মাইক্রোসফটের সিইও সত্য নাদেলার মতে আমাদের মধ্যে কেউই সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবল উল্টা বাতাস বা হেড উইন্ড থেকে বাঁচার বা প্রতিষেধক প্রয়োগের ক্ষমতা রাখি না। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমরা এমন একটি সময়ের মধ্যে আছি যেখানে প্রতিটি কোম্পানিকে ‘কম দিয়ে আরও বেশি’ করতে হবে।
লেখক : গবেষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
email : [email protected] সূএ: বাংলাদেশ প্রতিদিন